(২ ) সামাজিক জীবনের বৈশিষ্ট্য :
( ক ) কেন্দ্রীয় শাসকগােষ্ঠীর অস্তিত্ব :
ব্যাসামের মতাে অনেক ঐতিহাসিক হরপ্পার নগরগুলােতে কোনাে কেন্দ্রীভূত স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অস্তিত্ব ছিল বলে মনে করেন , তবে সেই শাসনব্যবস্থা রাজতান্ত্রিক না গণতান্ত্রিক ছিল সে বিষয়ে বিতর্ক আছে । ঐতিহাসিক হুইলারের মতে , হরপ্পা - মহেঞ্জোদারাে অঞ্চল আসলে ছিল একটি সাম্রাজ্য যার কেন্দ্রে ছিলেন একজন পুরােহিত রাজা।
( খ ) শ্রেণিবিভক্ত সমাজ :
শ্রেণিবিভক্ত সমাজ ছিল । হরপ্পা সভ্যতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য । সেই যুগে সমাজে তিন শ্রেণির মানুষের অস্তিত্ব ছিল , যথা : বিত্তশালী শাসকগােষ্ঠী , ধনী ব্যবসায়ী এবং দরিদ্র শ্রমিক কারিগর শ্রেণী। মিশর ও ব্যাবিলনের মতাে হরপ্পার সমাজে পুরােহিতদের খুবই প্রতিপত্তি ছিল।
( গ ) খাদ্য :
ধান , গম , যব , বার্লি , নানান ধরনের বাদাম , কড়াইশুটি , খেজুর , দুধ , মাছ , মাংস ও ডিম প্রভৃতি ছিল হরপ্পার অধিবাসীদের প্রধান খাদ্য।
( ঘ ) পােশাক - পরিচ্ছদ , অলংকার , যুদ্ধাস্ত্র ও গৃহস্থালির সরঞ্জাম :
হরপ্পা যুগে পােশাক পরিচ্ছদের জন্য প্রধানত সুতি ও পশম ব্যবহার করা হত । হরপ্পায় প্রচুর পরিমাণে সােনা , রুপা , তামা ও হাতির দাঁতের তৈরি অলংকার পাওয়া গেছে যা থেকে প্রমাণিত হয় যে , এযুগের নারী - পুরুষ সকলেই অলংকার ব্যবহার করত । হরপ্পা সভ্যতার যুদ্ধাস্ত্রের মধ্যে কুঠার , বর্শা , তীর - ধনুক ইত্যাদির নিদর্শনও পাওয়া গেছে । গৃহস্থালির কাজের ব্যবহারের জন্য হরপ্পার অধিবাসীরা ধাতু ও পােড়ামাটির তৈরি বাসনপত্র , কলশি , জালা , থালা , বাটি প্রভৃতি ব্যবহার করতেন।
(৩) ধর্মীয় জীবনের বৈশিষ্ট্য : ধর্মীয় জীবন :
হরপ্পা সভ্যতার একটি সিলমােহরে ত্রিমুখবিশিষ্ট এবং জীবজন্তু পরিবেষ্টিত যােগীমূর্তি পাওয়া গেছে । এই মূর্তি যােগীর আসনে উপবিষ্ট , তাঁর মাথায় আছে । শিং । এই যােগী দেবতাকে ঐতিহাসিক স্যার জন মার্শাল ‘ পশুপতি শিব ’ এবং ব্যাসাম আদি শিব ’ বলে অভিহিত করেছেন । এই সিলমােহর থেকে মনে হয় যে , এই সভ্যতার প্রধান উপাস্য দেবতা ছিলেন পশুপতি মহাদেব।হরপ্পাবাসীর দেবদেবীর পাশাপাশি গাছপালা , জীবজন্তু , সাপ , জল , নদী , পশু পাখি ! এবং সম্ভবত সূর্যের উপাসনা করতেন।
মৃতদেহ সৎকার ও পারলৌকিক বিশাস:
হরপ্পাতে একটি কবর আবিষ্কৃত হয়েছে । তাতে মনে হয় সেই সময় মৃতদেহ সমাধিস্থ করা হত ও সেই মৃতের ব্যবহার করা জিনিসপত্র ও অলংকার কবরে রাখা হত । অর্থাৎ হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরা পরলোকে বিশ্বাস করতেন।
(৪)অর্থনৈতিক জীবনের বৈশিষ্ট্য :
হরপ্পা সভ্যতার অর্থনৈতিক জীবন । আলোচনার ক্ষেত্রে তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা যায় , যেমন
( ক ) কৃষি ও পশুপালন :
নগরকেন্দ্রিক হলেও হরপ্পা সভ্যতার মূল ভিত্তি ছিল কৃষি ও পশুপালন । শহরগুলির বাইরে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে কৃষিকার্যের প্রচলন ছিল । এযুগে গৃহপালিত পশু হিসেবে গােরু , ষাঁড় , মহিষ , ভেড়া , কুকুর প্রভৃতি প্রতিপালন।
(খ ) শিল্প :
হরপ্পা সভ্যতা ছিল তাম্র প্রস্তর যুগের সমসাময়িক । টিনের সঙ্গে তামার মিশ্রণ ঘটিয়ে প্রস্তুত ব্রোঞ্জ দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র ও প্রয়ােজনীয় দ্রব্যসামগ্রী তৈরি হত । তবে সে যুগো লােহার ব্যবহার প্রচলিত ছিল না । বস্ত্র শিল্প , মৃৎশিল্প ও রনশিল্পে হরপ্পাবাসীরা উন্নত ছিল।
( গ ) ব্যাবসাবাণিজ্য:
ব্যাবসাবাণিজ্য ছিল নগরকেন্দ্রিক হরপ্পা সভ্যতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য । হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন স্থান ( সৌরাষ্ট্র , কাশ্মীর , বালুচিস্তান , দক্ষিণ ভারত প্রভৃতি অঞ্চল ) এবং বিদেশে ( মিশর , ক্রীট , পারস্য , সুমের , লাগাস প্রভৃতি অঞ্চল ) ব্যাবসাবাণিজ্য চলতাে । হরপ্পা সভ্যতার নগরগুলাে থেকে প্রধানত তুলাে ও সুতিবস্ত্র , হাতির দাঁতের তৈরি জিনিসপত্র , মণি - মুক্তো , ময়ূরপুচ্ছ প্রভৃতি বিদেশে রপ্তানি করা হত। সুতিবস্ত্র ও তুলাে ছিল হরপ্পা সভ্যতার প্রধান রপ্তানি দ্রব্য । তখনও এদেশে মুদ্রার প্রচলন হয়নি , তাই সেই যুগে বিনিময় প্রথার মাধ্যমেই শুধু ব্যাবসাবাণিজ্য চলত।
(৫) হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসের কারণ :
প্রামাণ্য তথ্যের অভাবে হরপ্পা সভ্যতার উত্থানের মতাে পতনের কারণ সম্বন্ধেও সঠিক কিছু জানা যায় না , তবে বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতামতের ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও আর্থসামাজিক বিপর্যয় এবং বৈদেশিক আক্রমণকেই হরপ্পা সভ্যতার পতনের অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করা হয় , যেমন :
[ ক ] প্রাকৃতিক বিপর্যয় :
( ১ ) সিন্ধু নদীতে প্রবল বন্যা ,
( ২ ) মহেঞ্জোদাড়াের কাছে প্রবল ভূমিকম্প ,
( ৩ ) কৃষির অবনতি , কৃষিক্ষেত্রে সমুদ্রের জল প্রবেশ করায় চাষের জমিতে লবণের পরিমাণ বৃদ্ধি ,
( ৪ ) জলবায়ুর হঠাৎ পরিবর্তনে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় বনভূমিগুলির ধবংসপ্রাপ্তি ও কৃষির অবনতি।
[ খ ] আর্থসামাজিক কারণ :
পৌর প্রশাসকদের অযােগ্যতায় মহেঞ্জোদারাে , হরপ্পা প্রভৃতি বড়াে বড়াে নগরগুলি ক্রমশ বসবাসের অযােগ্য হয়ে যায়।
[ গ ] বিদেশি আক্রমণ :
ক্রমাগত বিদেশি আক্রমণ ছিল হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসের অন্যতম কারণ , ঐতিহাসিক তুইলারের মতে , এইসব আক্রমণকারীদের অনেকেই ছিল বৈদিক আর্য।
পরিশেষে বলা যায় সভ্যতার পতনের মূলে বিভিন্ন কারণের সমাবেশ ঘটেছিল। তবে সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত সিন্ধু সভ্যতার বিলুপ্তির রহস্য সঠিকভাবে উদ্বাটন সম্ভব নয়।
(৬) বিশ্বের সমকালীন অন্যান্য সভ্যতার সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার সম্পর্ক :
সেই প্রাচীনযুগেও বিশ্বের জাতিগুলি একে অপরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন ছিল না। সেই যুগেও জলপথে ও স্থলপথে মানবজাতির গমনাগমন ছিল । মিশরীয় ও আসিরীয় ব্যাবিলনীয় সভ্যতার সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার যােগাযােগ ছিল কারণ :
( ১ ) মেসােপটেমিয়া ও মহেঞ্জোদাড়াের সিলমােহরগুলির মধ্যে বেশ মিল দেখা গিয়েছে।
( ২ ) হরপ্পা সভ্যতার সিলমােহরযুক্ত কাপড়ের গাঁট , পােড়ামাটির শীল ও রুদ্রাক্ষ মেসােপটেমিয়ায় পাওয়া গেছে।
( ৩ ) হরপ্পা সভ্যতার বেলনীর মতাে সিলমােহরের নিদর্শন প্রভৃতি সুমেরের উর , লাগাস প্রভৃতি অঞ্চলে পাওয়া গেছে । এ থেকে মনে হয় জলপথে মিশর ও স্থলপথে সুমেরীয় অঞ্চলের সঙ্গে সিন্দুবাসীদের বাণিজ্যের চলাচল ছিল । গুজরাটের লােথালে আবিষ্কৃত প্রাগৈতিহাসিক জাহাজঘাটা এই আনুমানিক সত্যি প্রমান করেছে।
( ৪ ) পশ্চিম এশিয়ার ‘ আক্কাদ’অঞ্চলে ভারতীয় বণিকদের উপনিবেশেরও অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
(৭)হরপ্পা সভ্যতার অবদান :
হরপ্পা সভ্যতার উল্লেখযােগ্য অবদান ছিল :
( ১ ) বিশ্বের প্রথম নগর পরিকল্পনা , প্রথম নগর - কেন্দ্রিক সভ্যতা ,
( ২ ) প্রথম পৌরসংস্থা ,
( ৩ ) প্রথম স্থাপত্যকলা এবং
( ৪ ) জনগণের কল্যাণমূলক প্রথম পরিকল্পনা।
0 Comments